জৈব কৃষির এক সরব অভিযাত্রী : সেলিনা জাহান
মাটি ও মানুষের কৃষি ডেস্ক
মাটি আর ফসলের সঙ্গে নিবিড় প্রেম কৃষকের। মাটিতে অংকুরিত ফসল যেমন জানান দেয় তার খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা। বিপর্যস্ত মাটিও বলে দেয়, তার শক্তি হারানোর যন্ত্রণা। মাটি তার সর্বস্ব বিলিয়ে চলেছে ফসলের পেছনে। আমরা তাকিয়ে থাকি ফসলের দিকে। কিন্তু ফসলের ভলমন্দের জন্য যে জননীর সকল অবদান সেই মাটির কথা খুব বেশি ভাবি না। যেসব কৃষক নিবিড়ভাবে এই চিত্র উপলব্ধি করেছেন তারা সত্যিই ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন।
এই অবস্থায় সত্যিই মাটি বার বার আমাদের কাছে চাইছে পুষ্টিকর খাদ্য। মাটি- যাকে আমরা জননী বলছি, সেই জননীর ব্যথা যেন খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করছেন আরেক জননী। বলছি নরসিংদীর সেলিনা জাহানের কথা। যিনি গ্রামীণ নারীদের চার দেয়ালের ভেতর থেকে টেনে বের করে এনেছেন ফসলের মাঠে। একেকজন নারীর মনে যিনি রোপণ করেছেন স্বাবলম্বি হওয়ার ইচ্ছের বীজ। আর জানান দিয়েছেন, যে নারীর হাত দিয়ে একদিন এই কৃষির আবির্ভাব, কৃষিকে সচল রাখতে হাল ধরতে হবে সেই নারীদেরকেই।
নরসিংদীর শিবপুর, রায়পুরা উপজেলার গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে পেঁৗছেছেন সেলিনা জাহান। সাংসারিক নানা সমস্যা আর সংকটে পিছিয়ে পড়া নারীরা তার চোখেই দেখেছেন এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। সবজি চাষ, পোল্ট্রি খামার, ছোট ছোট ফলের বাগান করে কেউ কেউ স্বাবলম্বিও হয়েছেন। আবার অনেকেই পরিবেশসম্মত ও বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করে সাফল্য দেখিয়েছেন। এই এলাকায় চ্যানেল আই-এর হূদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের পক্ষ থেকে বেসরকারি সংগঠন সেফ এগ্রিকালচার ও স্থানীয় কৃষি বিভাগকে সঙ্গে নিয়ে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের যে অভিযান শুরু হয়, তা স্বউদ্যোগে এগিয়ে নিয়ে যান সেলিনা জাহান। এ যেন বিষের বিরুদ্ধে এক অভিযান। ক্ষতিকর রাসায়নিকের বিরুদ্ধে এক সামাজিক আন্দোলন। যেখানে রয়েছে মাটি পরিবেশ তথা গোটা জনস্বাস্থ্যকে বাঁচানোর তাগিদ। এর ধারাবাহিকতায় গ্রামীণ নারীরা সম্পৃক্ত হয়েছেন কেঁচো কম্পোস্ট অর্থাৎ জৈব সার তৈরির একটি কার্যকর অভিযানে। সেখানেও মধ্যমণি সেলিনা জাহান।
নরসিংদী শিবপুর উপজেলার সৈকারচর গ্রাম। ওই গ্রামেই সেলিনা জাহানের বাবার বাড়ি। বাড়িটির পাশেই সেলিনা তার নিজের জমিতে গড়ে তুলেছেন জৈব সার তৈরির মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের আয়বৃদ্ধির প্রকল্প। শুরুটা ২১জন নারী দিয়ে। কেঁচো কম্পোস্ট তৈরির এই কাজটি এখন এই নারীদের কাছে বাণিজ্যিক এক কৃষি উৎপাদন।
অল্পদিনের উদ্যোগীই এলাকার নারীরা বুঝে গেছেন প্রাকৃতিক লাঙল কেঁচোর গুরুত্ব। কোনটি হাইব্রিড কেঁচো, কোন কেঁচোর সার উৎপাদন ক্ষমতা ভাল, আর কোন কেঁচোর মাধ্যমে ভাগ্য খুলে যাচ্ছে এই হিসাবগুলো এখন সব নারীরই জানা। হাউস তৈরি, গোবর, কলাগাছ ও কচুরিপানার মিশ্রণের মধ্যে সার তৈরির মূল উপাদান কেঁচো প্রয়োগ, ৪৫ দিনে সার উৎপাদন এবং উৎপাদিত সার জমিতে প্রয়োগের উপযোগী করার কাজটির মধ্যে আলাদা এক আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন নারীরা। কারণ এখান থেকে ভালই অর্থ আসছে তাদের। আর এই উৎসাহ এখন পেঁৗছে গেছে বিভিন্ন এলাকায়। সবখানেই সেলিনা জাহানের দেখানো পথে ছুটছেন একে একে অনেকেই। নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় এখন নারীরা সংগঠিত হয়ে গড়ে তুলছেন কেঁচো কম্পোস্ট পস্নান্ট। আর পস্নান্টের একেকটি হাউস একেকজন নারীর কর্মস্থল।
নারীদের এই এগিয়ে আসা এবং তাদের উদ্বুদ্ধ করার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন মহলের আন্তরিক উদ্যোগ ও সহায়তা। এক্ষেত্রে সক্রিয় উদ্যোগ নিয়ে স্থানীয় কৃষকদের খুব কাছে এসে কেঁচো কম্পোস্ট প্রকল্পকে এগিয়ে নিচ্ছেন নরসিংদীর জেলা প্রশাসক অমৃত বাড়ৈ।
কৃষি বিভাগ কীভাবে সহায়তা করেছে এ প্রশ্ন নিয়ে কথা হল স্থানীয় উপ সহকারি কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে। তিনি জানিয়েছেন, আমরা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কীভাবে কী করতে হবে তার সহযোগিতায় কমতি করছি না।
তৃণমূলে কোনো কোনো ইউনিয়ন পরিষদও জৈব কৃষির এই অভিযানে বেশ উদ্যোগী। তাদের মধ্যে একজন নরসিংদীর যশোর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন। তিনি জানালেন, এই এলাকায় কেঁচো কম্পোস্ট ছড়িয়ে পড়ার শুরুর দিকেই তার ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় প্রশিক্ষণের। সেখানেই প্রথম প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন সেলিনা জাহান।
এ তো গেল উৎকৃষ্ট জৈব সার উৎপাদনের প্রসঙ্গ। মাঠ পর্যায়ে এই জৈব সার ব্যবহারের কার্যকারিতায় এসেছে সুফল। এবার আমন মৌসুমে জৈব সার ব্যবহার করে তারা কীভাবে উৎপাদন খরচ সাশ্রয় করেও পেয়েছেন অনেক বেশি ফলন।
যারা সবজি ফসলে এই কেঁচো জৈব সার ব্যবহার করছেন তারা শুধু সারের ব্যয়ই কমাচ্ছেন না, রীতিমত কীটনাশকের খরচ থেকেও রেহাই পাচ্ছেন। এই কেঁচো সার দেয়ার কারণে পোকা-মাকড়েরর আক্রমণ কম হচ্ছে।
এই এলাকায় জৈব সার উৎপাদন তথা এতসব সাফল্যচিত্রের পেছনে সবচেয়ে নিবিড় ভূমিকা সেলিনা জাহানের। যিনি তার জীবনকেই নিবেদন করেছেন স্বাস্থ্যকর কৃষির পেছনে। কৃষিক্ষেত্রে সেলিনা জাহানের পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও একের পর এক নতুন পদ্ধতি সম্প্রসারণের সাংগঠনিক দক্ষতা যেকোনো এলাকার শিক্ষিত সচেতন নারী-পুরুষের জন্যই হতে পারে অনুকরণীয়। সেলিনা জাহান আজ শুধু কৃষকেরই সহায়ক নন, তিনি গবেষক ও বিজ্ঞানীদের সহায়ক, সহায়ক দেশের কৃষি সম্প্রসারণ ব্যবস্থার। দেশের প্রত্যেক এলাকায় এমন উদ্যোগী সংগঠক এখন সময়েরই চাহিদা।
Source: Daily Ittefaq
No comments:
Post a Comment